নিম্ন মধ্যবিত্ত ব্যাচেলর ফেসবুক সেলিব্রেটি
আধা-পাকা চুল, আর আয় বুড়ো খোঁচা-খোঁচা দাড়িওয়ালা সেন্টু মিয়ার দুঃখের শেষ নেই। দুঃখও কেউ বুঝেনা। যেমন সে দিন সেন্টু মিয়া ইশারা ইঙ্গিতে তার মাকে বললো, “মা, মাথার চুল সব সাদা হয়ে যাচ্ছে”।
সেন্টু মিয়ার মা সরাসরি উত্তরে বলল, “তবে, মেহেদি লাগাও”।
এবার কুরবানির ঈদে আরেক বার সুযোগ পেয়ে তার মাকে আবারও বললো, “মা, মাগো… আপনাদের কারওই গরুর গোশত রান্না আর আগের মত ভালো লাগেনা”
মাও বলল, “বুঝি, সব বুঝি……. তবে যাও একটা বুয়া ঠিক করে আসো”!
সেন্টু মিয়া ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিলো, “কেউ আমাকে ২ টাকার শান্তি দেন, তাও ১ টাকা বাকিতে”!!
বেকার সেন্টু মিয়ার আর কিবা করার আছে। বেকারত্ব ঘুচাতে, ব্যক্তিত্ব বাড়াতে, বিয়ের যোগ্য হয়ে উঠতে সেন্টু মিয়া চলে আসে ঢাকায়। কয়েক মাস মেসে থেকে অনেক কষ্টে সৃষ্টে একটা চাকুরি জুটিয়ে নেয়। চাকরির কয়েক বছরের মধ্যে সেন্টু মিয়া আর সেন্টু মিয়া থাকেনা। ফেসবুকে বিশাল পরিচিতিতে হয়ে যান “জনাব সেন্টু মিয়া”। আর তার স্ট্যাটাসের খ্যাতিও ভালো। ২০১৫ সালে কতিপয় ফেসবুক বিশেষ ভাবে অজ্ঞ দলের জরিপ অনুযায়ী সেন্টু মিয়াকে “নিম্ন মধ্যবিত্ত টাইপের একজন ব্যাচেলর ফেসবুক সেলিব্রেটি” হিসেবে খেতাব দেওয়া হয়েছে। সেন্টু মিয়ার গড় প্রতি পোস্টে এখন লাইক একশ থেকে দেড়শ আর কমেন্ট ৪০ থেকে ৪২। কমেন্টগুলো বেশির ভাগেই থাকে, ভেরি ফাইন, হুম, ওসাম, ইত্যাদি টাইপের।
সেন্টু মিয়া যেহেতু একজন ফেসবুক সেলিব্রেটি হোকনা সে “নিম্ন মধ্যবিত্ত টাইপের”, সেহেতু ব্যাচেলর ফেসবুক সেলিব্রেটির নতুন বাসা খুঁজতে হবে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে। “আই নিড এ ভালোবাসা, ইফ ইউ হ্যাব, প্লিজ গিব মি ওয়ান”। এই স্ট্যাটাসে লাইকের চেয়ে কমেন্ট পরেছে বেশি। বেশির ভাগ কমেন্ট হলো, বিয়া করেন সেন্টু ভাই, সিট খালি নাই সেন্টু ভাই, ব্যাচেলর ভাড়া হবে না, লুল, ইত্যাদি। বাসা খুঁজতে গিয়ে মুশকিল হলো এক জায়গায়, বেশির ভাগ টু-লেটে লেখা থাকে ব্যাচেলর ভাড়া হবে না। সবারই প্রথম জিজ্ঞাসা আপনি কি বিবাহিত, আপনি কি আপনার বৌকে নিয়ে থাকবেন, আপনার কয়জন সন্তাদি! সেন্টু মিয়া মনে মনে বলে, “তাও ভালো, আপনি কয়টা বিয়ে করেছেন তাতো আর জিজ্ঞাসা করেনি!”
সেন্টু মিয়া চিপা গল্লি দিয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে হাঁটে আর ভাবে। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত চোখে এক টু-লেটে চোখে পড়ল, চাকরিজীবী ব্যাচেলরদের জন্য ফ্ল্যাট বাসা ভাড়া হবে। উল্লেখিত নাম্বারে ফোন দেওয়ার পর রিসিভ করলেন আপা টাইপের একজন। ওনার কথার স্মার্টনেচও উনাকে আপা ডাকার সম্ভাবনাকে বৃদ্ধি করেছে। বাসার নিচে অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর উনি এলেন, হালকা ম্যাকাপ নিতে হইতো একটু দেরি করেছেন। বাসা দেখার পর সেন্টু মিয়া বললেন, “আপা আপনার ভালো-বাসা আমার পছন্দ হয়েছে”। আপা বললেন, “দেখো, তুমি আমার ছেলের মত, আশা করি আমার এখানে কোন সমস্যা হবেনা”। ভাবুক আর টাসকিত সেন্টু মিয়া ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিল, “ভালোবাসা নাইরে, ভালোবাসা নাই…..”।
সহজে দমে যাওয়ার পাত্র সেন্টু মিয়া নন। কয়েক দিন পর এক বাসা দেখতে গিয়ে বাড়িওয়ালিকে বলে “আংটি আপনার ভালো-বাসার ভাড়া অনেক বেশি যদি একটু কমিয়ে দিতেন। বাড়ীওয়ালী আংটি বলল, “দেখেন ভাই, আমি আছি এক বিপদে, এক মেয়ে পড়ে ক্লাস টেনে, আরেক মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট। খরচাপাতি বেশি তাই ভাড়াও বেশি”। সেন্টু মিয়া আবার টাসকি খায় আর মনে মনে ভাবে, সব ঠিক ঠাকই-তো ছিলো মাঝে আংটি আমাকে ভাই বলেই-ত ভেজালটা লাগাইছে। যারে আংটি বললাম সে বলে ভাই। এর আগের বার যারে আপু বললাম, সে বলে, “আমি নাকি ওনার ছেলের মত”। যাইহোক কোন এক অদৃশ্যের টানে সেন্টু মিয়াকে সে বাড়ি ভাড়া নিতে হলো। নতুন বাসায় উঠা মাত্রই ফেসবুকে স্ট্যাটাস, “আমাদের নতুন বাসা খুব ভালো, দুই বেড, দুই বার্থ, দুই বারান্দা আর বাড়িওয়ালির মেয়ে ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, হু..হা…হি…”!!
এই স্ট্যাটাসে সেন্টু মিয়া অনেক কনগাচুলেশন পায়। “চালিয়ে যান সেন্টু ভাই আমরা আছি আপনার পাশে” টাইপের কমেন্ট আসে।
সেন্টু মিয়া নতুন বাসায় বারান্দায় বসে চা খায়। কবিতার বই পড়ে। ফেসবুকে নতুন বাসার আপডেট দিয়ে একটি পোস্টও দেয়,“ছোট রুমের সাপেক্ষে বড় দক্ষিণা বারান্দায় বসে ধোঁয়া উঠা কফির চুমুকের সাথে সামনের বাসার উত্তরা জানালায় চোখা-চোখি একটু একটু করে বেশ জমে উঠেছে। এতে নতুন বাসায় যতই পানির সমস্যা আর গিঞ্জি খাওয়া রুম হোকনা কেন, প্রতিবেশীর সাথে ভদ্রতার সুসম্পর্ক বজায় রেখে একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ-এর আশায় বেশি বাড়ি ভাড়া দিয়ে হলেও সব সমস্যা মেনে সামনে এগিয়ে যাওয়াই একজন আদর্শ চতুর তীক্ষ্ণবুদ্ধি-সম্পন্ন ব্যাচেলর ভাড়াটিয়ার লক্ষণ”।
দুই মাস পরে সেন্টু মিয়া বাড়ি ভাড়া দিতে যায় বাড়িওয়ালির কাছে, দরজা খুললো ওই কথিত ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট। সেন্টু মিয়া বলল, “আপা কি বাসায় আছেন”? নাম না জানা ফাস্ট ক্লাস ফাস্ট বলল, “ভাইয়া আপনি ভিতরে বসুন, আমি আম্মুকে ডেকে দিচ্ছি”। সেন্টু মিয়া তৃতীয় বারের মত টাসকি খায়, সেন্টু মিয়ার মাথা ঘুরে, বমি বমি লাগে। হায় এখন আমার কি হবে…।
ওই ভাইয়া ডাক যে সেন্টু মিয়ার ভালো লাগলো সে অনুভূতি বুঝা গেলো ফেসবুক স্ট্যাটাসে।
“আজকে আমার মনে অনেক আনন্দ…. বাড়িওয়ালি আপার মেয়ে আজকে আমাকে ভাইয়া…বলে ডেকেছে”!!
বুঝায় যাচ্ছে, বিশেষ খাতিরের কারণে সেন্টু মিয়া দিন দিন শিখর থেকে শিখরের দিকে যাচ্ছে। তবে কয়েক মাসের বাসা ভাড়ার বকেয়ায় কায়দা হারিয়ে লব্ধ আত্মসম্মান ধরে রাখার লক্ষে কয়দিন ধরে বাড়িওয়ালার ফ্ল্যাটের সামনে দিয়ে তাড়া-হুড়া করে যাওয়া আসা করতে হচ্ছে।
সেন্টু মিয়া যন্ত্রর-মন্ত্রর টাইপের কবিতা দিয়ে বধ করার চেষ্ট করছে-
“তোমার নামে গিট্টু বেঁধেছি ভালোবাসার রঙিন চশমায়…
অচেনা অজানা হে মহীয়সী, হাজির হও, হাজির হও….
সু মন্ত্রর সু… কিলি-বিলি…যধু-মধু-কধু…হা-হি-হু…
এসে যা এসে যা….!!!”
আর কোন যন্ত্রর-মন্ত্রর কাজ হলোনা।
তার পরের মাসে বাড়িওয়ালির নোটিশ, আগামী মাসে বাসা ছাড়তে হবে।
সব গেলো, সেন্টু মিয়া ভালোবাসা হারালো। “ মনের ভিতরে আগুন জ্বলে (ভিডিও সহ)।” স্ট্যাটাসের পরের দিন সেন্টু মিয়ার আজ বাসা ছাড়তে হবে। আজকে আবার বসন্তের প্রথম দিন, বাসা ছাড়ার আগে ফেসবুকে আবার স্ট্যাটাস দিলো,
“কত বসন্ত এলো-গেলো।
কত জনের বাগানেই না ফুল ফুটলো,
শুধু আমার বাগানে পাখিই বসেনা। ”
একজনে কমেন্টে লিখলো, “যে বাগানে শুকুনের চোখ, সে বাগানে সাধারণত ফুল ফুটেনা, অন্য পাখিও বসেনা।”
লেখাটি ১৭ জুলাই, ২০১৬ তারিখে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত
Leave a Reply